ঢল হাওরে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার ও হবিগঞ্জে তলিয়ে গেছে ১২ হাজার হেক্টর জমির ফসল

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলায়ও হাহাকার পড়ে গেছে। খয়েরপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক শামসুল হক জানান, নিজের দুই একর জমিসহ তাঁর গ্রামের সব কৃষকের বোরো জমিই পানির নিচে। চার বছর ধরে আগাম বন্যায় হাওরের ফসল নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার সব শেষ। কান্দনই অহন পুঁজি। ’

অষ্টগ্রাম উপজেলার কলাপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আহাদ জানান, এবার তিনি প্রায় ৫০ একর জমি চাষ করেন। চাষাবাদের পেছনে খরচ করেছেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছিল। ধান কাটতে পারলে কমপক্ষে তিন হাজার মণ ধান পেতেন। এ অবস্থায় এক মুঠো ধান পাওয়ার জো নেপ্রায় ৪০ বছর পর আবার চৈত্র মাসে হাওরের কৃষক ভয়ানক দুর্যোগের মুখে পড়েছে। অসময়ে টানা বর্ষণ,

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলায়ও হাহাকার পড়ে গেছে। খয়েরপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক শামসুল হক জানান, নিজের দুই একর জমিসহ তাঁর গ্রামের সব কৃষকের বোরো জমিই পানির নিচে। চার বছর ধরে আগাম বন্যায় হাওরের ফসল নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার সব শেষ। কান্দনই অহন পুঁজি। ’

অষ্টগ্রাম উপজেলার কলাপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আহাদ জানান, এবার তিনি প্রায় ৫০ একর জমি চাষ করেন। চাষাবাদের পেছনে খরচ করেছেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছিল। ধান কাটতে পারলে কমপক্ষে তিন হাজার মণ ধান পেতেন। এ অবস্থায় এক মুঠো ধান পাওয়ার জো নেই। তিনি জানান, তাঁর এলাকার প্রান্তিক ও মধ্যমানের চাষিদের এবার ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

কিশোরগঞ্জ , নেত্রকোনা,সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ হাওরাঞ্চলের এক লাখের বেশি হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন করে ডুবছে আরো জমি।

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলায়ও হাহাকার পড়ে গেছে। খয়েরপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক শামসুল হক জানান, নিজের দুই একর জমিসহ তাঁর গ্রামের সব কৃষকের বোরো জমিই পানির নিচে। চার বছর ধরে আগাম বন্যায় হাওরের ফসল নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার সব শেষ। কান্দনই অহন পুঁজি। ’

অষ্টগ্রাম উপজেলার কলাপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আহাদ জানান, এবার তিনি প্রায় ৫০ একর জমি চাষ করেন। চাষাবাদের পেছনে খরচ করেছেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছিল। ধান কাটতে পারলে কমপক্ষে তিন হাজার মণ ধান পেতেন। এ অবস্থায় এক মুঠো ধান পাওয়ার জো নেই। তিনি জানান, তাঁর এলাকার প্রান্তিক ও মধ্যমানের চাষিদের এবার ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার তিনটি বাদে বাকি সব তলিয়ে গেছে। স্থানীয় একটি সংগঠনের হিসাবে অন্তত দেড় লাখ হেক্টর জমির কাঁচা ধান তলিয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে ডুবে গেছে প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমি। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি ও হবিগঞ্জে তলিয়ে গেছে আরো অন্তত ৩৬ হাজার হেক্টর জমির ধান। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া সিলেটে হঠাৎ বন্যায় তলিয়ে গেছে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ফসল।

হাওরাঞ্চলের কৃষকরা বলছে, ১৯৭৭ সালের পর একফসলি আবাদের এ অঞ্চলে এমন দুর্যোগ তাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। অনেকে ঋণ নিয়ে জমি আবাদ করেছিল। তাদের পথে নামা ছাড়া উপায় নেই।

‘এবার মানুষ না খেয়ে মরবে’ : আব্দুল মান্নান (৬৫) সুনামগঞ্জের বোরো ভাণ্ডার খ্যাত দেখার হাওরপারের বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক। গতকাল মঙ্গলবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়েছেন হাওরের ছালুরাকান্দার উঁচু এলাকায় যে অল্প জমি রয়েছে তা দেখতে। দেখলেন, ধীরে ধীরে পানি সেই জমিও গ্রাস করছে। আর কোনো অবশিষ্ট জমি নেই তাঁর।

মান্নান বলেন, ‘চৈতমাইয়া দিনো ইলা আর আওর নেয়নি। ঠেইল্ল্যা আইয়া পানি ডুকি যার। ’ তিনি হাত উঁচিয়ে দেখান, ‘ওই দেখো বাবা, জমিন বুরি যার। ’ (চৈত্র মাসে এমনভাবে আর হাওরে ঢোকেনি। প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করছে। এই দেখো বাবা, জমি ডুবে যাচ্ছে। ) তিনি জানান, এবার চরম দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে কৃষক। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা করে দ্রুত সহায়তার দাবি জানান তিনি।

একই হাওরে লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের বারোঘর গ্রামের বাবুল চন্দ্র দাশ ৩৬০ শতক জমি ধারদেনা করে বর্গাচাষ করেছেন। তিনি কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। গতকাল দুপুর দেড়টায় তাঁর স্ত্রী বাসন্তী রানী দাস এক জা ও প্রতিবেশীকে নিয়ে তিন মাইল হেঁটে হাওরের পাশে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘২০ আজার টাকা সুদ আইন্যা পরার জমিন আইধ্যা করছিলাম। ১০ কেয়ার জমিন নিছেগি। দুই কিয়ার জমিন পাইন্যে বুরিযার। ’ (২০ হাজার টাকা সুদ এনে অন্যের জমিন বর্গাচাষ করেছি। এর মধ্যে ৩০০ শতক জমি ডুবে গেছে। বাকি ৬০ শতকও ডোবার পথে। ) তিনি বলেন, ‘ইবার কিতা খাইমু, বাইচ্চারারে কিতা খাবাইমু।

৮০ টাকার চাউল আছকু ১২৫ টাকায় কিনছি। ’ (এবার কী খাবো, বাচ্চাদের কি খাওয়াবো। ৮০ টাকার চাল এখন ১২৫ টাকায় কিনছি। )

কৃষকরা জানান, এভাবে চৈত্র মাসের শুরুতে ১৯৭৭ সালে একবার দুর্যোগের মুখে পড়েছিলেন কৃষকরা। তবে ওই সময় কিছু হলেও ফসল তুলতে পেরেছিলেন তাঁরা। এবার একমুঠো ধানও তোলার উপায় নেই।

প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি : ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক বিজন সেন রায় বলেন, চোখের সামনে সব হাওর তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘১১ উপজেলার তিনটি হাওর বাদে সব হাওর তলিয়ে গেছে। আমাদের হিসাবে দেড় লাখ হেক্টরের বেশি জমি তলিয়ে গেছে। প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে। ’

উল্লেখ্য, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলায় ছোট-বড় ১৩৩টি হাওর রয়েছে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে হাওরের সংখ্যা ৪২।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, গত ২৯ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। যার আর্থিক মূল্য ৯৯০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট হাওরের ফসলও ডুবে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।

জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফসর উদ্দিন বলেন, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে বোর্ডের আওতাধীন ১৯টি হাওরের বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। পাহাড়ি ঢলে পানি বাড়ছে।

জানা গেছে, গত ৩০, ৩১ মার্চ ও ১ এপ্রিল এ অঞ্চলে তুমুল বৃষ্টিপাত হয়। এর আগে হয় বিচ্ছিন্ন শিলাবৃষ্টি। শিলাবৃষ্টিতে ফসলের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। তবে বৃষ্টির পানিতেই কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায় কিশোরগঞ্জের অনেক এলাকার বোরো ফসল। এর সঙ্গে কুশিয়ারা ও সুরমা নদী হয়ে আসা পাহাড়ি ঢলের ঘোলা পানিতে আরো এক ফুট ফসলি জমি তলিয়ে যায়।

সরেজমিনে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে অষ্টগ্রামের হাওরের। তিন দিনে উপজেলার আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের রায়দল, চন্দনা, বাজুকার দাইর ও কর আবদার হাওর, বল্লি, বাজখাইল, বালুচর উত্তর, চিত্রা, কালীপুর-গয়েশ্বর বিল ও খয়েরপুরের গোপ, আদমপুর ইউনিয়নের রোয়ার বিল, নতুনচর, নূরপুর বালুচর, বিল মাশরাইল ও উজলার হাওর, কলমা ইউনিয়নের বিল মাকসা, পাথুরিয়া ও বেড়ি বিল, পূর্ব অষ্টগ্রামের দক্ষিণের হাওর ও বিল মাকসা, অষ্টগ্রাম সদরের বারইচর ও বিল বল্লি, দেওঘর ও কাস্তুলের দোবা বিল, বাঙ্গালপাড়ার কালীপুর হাওরের অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।

কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মিঠামইনের ঢাকী ইউনিয়নের চারিগ্রামের পূর্বপাশের হাওর ও যাদবপুর হাওর ও বৈরাটী ইউনিয়নের কয়েকটি হাওরও তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের কাদিরখলার পশ্চিম ও উত্তরের হাওর, কেওয়ারজোড় গ্রামের পূর্ব পাশের হাওর এবং ঘাগড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন হাওর নিমজ্জিত হয়েছে। অন্যদিকে ইটনার বরিবাড়ির মেন্দার হাওর ও বাদলার বহু এলাকা এবং করিমগঞ্জের সুতারপাড়া ইউনিয়নের চর নোয়াগাঁওসহ অনেক এলাকার ফসল তলিয়ে গেছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, গতকাল কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরের ১৮ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। তবে হাওরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ সরকারি হিসাবের প্রায় দ্বিগুণ হবে।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও পাশের সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ উপজেলায় এক সপ্তাহ ধরে টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে এ পর্যন্ত ছোট-বড় প্রায় ৪৯টি হাওরের প্রায় ৪০ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির কাঁচা ও আধাপাকা বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি টাকার ওপরে। ওই সব এলাকার কৃষকরা তিন-চার দিন ধরে গোখাদ্য সংকটসহ নিজেরা বাঁচার তাগিদে তাদের গোয়ালে থাকা সব গরুই স্থানীয় হাটবাজারে এনে বিক্রি করে দিচ্ছে।

মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মফিজুল ইসলাম নাফিস বলেন, এ উপজেলার চরহাইজদা নামের একমাত্র ফসল রক্ষা বাঁধটি জালালের কুঁর এলাকায় ভেঙে গেছে। গত শনিবার রাতে বিশাল ডিঙ্গাপোতা হাওরসহ ছোট-বড় ২০টি হাওরের প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

খালিয়াজুরীর সবচেয়ে বড় দুটি বাঁধ কীর্তনখোলা ও নাইওরীর খাল সোমবার সন্ধ্যায় ভেঙে গেছে। এতে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর আধাপাকা বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কীর্তনখোলা বাঁধের আওতাধীন পাংগাশিয়া হাওরের প্রায় এক হাজার ১০০ হেক্টর জমির ফসল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩১ কোটি টাকা। নাইওরীর খাল বাঁধ ভেঙে ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে কৃষ্টপুর, চাকুয়া, গাজীপুর, মেন্দিপুর, খালিয়াজুরী সদরে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তোফায়েল আহমেদ জানান, এ উপজেলায় প্রায় চার হাজার ২০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় কালনী, কুশিয়ারা ও ভেড়ামোহনা নদীতে গত ২৪ ঘণ্টায় চার ফুট পানি বেড়েছে। বর্তমানে সেখানে বিপত্সীমার ১৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর এক ফুট পানি বাড়লেই বাঁধ তলিয়ে যাবে। ফলে কৈয়ার ঢালা প্রকল্পের ১১ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাবে। পাশাপাশি আশপাশের হাওরগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে দুই হাজার ৫২০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান, ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। মাহতাবপুর এলাকার ফসল বিনষ্ট হয়েছে।

সিলেটের ১০টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। জেলার সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ। গতকাল বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের সভায় স্থানীয়ভাবে উপজেলাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে সরকারিভাবে এটি ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে। সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন হাওরের বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে মোগলগাঁও ইউনিয়নের জিলকার হাওর, হাটখোলা ও জালালাবাদ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের সব হাওরে ফসলহানি হয়েছে। সিলেট মহানগরসংলগ্ন দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় ছয় হাজার হেক্টর বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। বিশ্বনাথ উপজেলার আট ইউনিয়নে রবিশস্য ও বোরো ধান তলিয়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ছয় হাজার ২৫০ হেক্টর বোরো ধানের জমি।

সরকারি দপ্তরের লুকোচুরি : সুনামগঞ্জে কাঁচা ফসল পানিতে তলিয়ে গেলেও জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ড ফসলের ক্ষতি নিয়েও লুকোচুরি করছে। প্রকৃতপক্ষে দেড় লাখ হেক্টরের বেশি জমি তলিয়ে গেলেও কৃষি বিভাগ গতকাল বিকেল ৫টায় জানিয়েছে মাত্র ৭৯ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে।

অন্যদিকে জেলার বৃহত্তম ৪২টি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে জড়িত পানি উন্নয়ন বোর্ড গতকাল বিকেলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, মাত্র ১৯টি হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। তবে ডুবে গেলেও ক্ষতির পরিমাণ কম। মাত্র ২০ হাজার হেক্টর বলে তারা জানিয়েছে। এভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি বিভাগ ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আড়াল করে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে গত সোমবার সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তারা অভিযোগ করেছিলেন। কৃষক নেতারা নানা কর্মসূচিতে হাওরের কৃষক বাঁচাতে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে জড়িতদের দুর্নীতির শাস্তি দাবি করেছেন। এ ছাড়া অবিলম্বে হাওরের কৃষি বাঁচাতে নদ-নদী খননের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যায় ফসলহানিতে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে গতকাল বিকেলে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা। মানববন্ধন চলাকালে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বক্তারা হাওর অঞ্চলের নদীগুলো খনন, কিছু জায়গায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ এবং সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার জন্য দাবি করেন। এতে সিলেটের সর্বস্তরের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা ও হাওরবাসী উপস্থিত ছিল।

বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে মরিয়া কৃষক : কিশোরগঞ্জের হাওরের একেবারে পূর্ব পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে কুশিয়ারা নদী। নদীর পশ্চিম পারের চারটি বাঁধের ভেতর কয়েক হাজার একর জমির ধান এখনো তলিয়ে যায়নি। গত রবিবার সকালেই হুমকির মুখে পড়া বিলমাকসা বাঁধটি আশপাশের গ্রামের কৃষকদের আপ্রাণ চেষ্টায় রক্ষা পায়।

বাঁধ রক্ষায় ব্যস্ত কাকুরিয়ার কৃষক রামচরণ দাস (৪২) কালের কণ্ঠকে আক্ষেপের সুরে বলেন, জীবন দিয়ে এভাবে বাঁধ ঠেকানোর পরও যদি ভগবান ফিরে না চায়, তাহলে কী করার আছে!

কৃষি বিভাগের ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. আব্দুল মুঈদের নেতৃত্বে সোমবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি দল সরেজমিন হাওর এলাকা পরিদর্শন করে। ড. মুঈদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বাঁধগুলো দুর্বল হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এসব বাঁধ আরো শক্তসমর্থ হওয়া দরকার, না হয় হাওরের ফসল রক্ষা করা সম্ভব নয়। ’

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মাসুদুর রাব্বী জানান, কীর্তনখোলা বাঁধ যেখানে ভেঙেছে, পানি না বেড়ে সে অবস্থায়ই থাকলে ক্ষয়ক্ষতিটা অন্যান্য বাঁধের ওপর প্রভাব ফেলবে না। আর যদি বেড়ে যায় তাহলে এর পাশাপাশি অন্যান্য ফোল্ডারের বাঁধগুলো যেমন মরা খাল, কল্লা, ফরিদপুরের ঘনা এসব প্রকল্প আরো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়বে।

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে বাঁধ রক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বানিয়াচং উপজেলার নোয়াগড় গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঢলের হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কৃষকরা। কৃষক শাহজাহান জানান, কাটা গাঙে দীর্ঘদিন যাবৎ খনন না হওয়ায় পলি পড়ে তা ভরে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই হাওর হুমকিতে পড়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার নলাইর হাওর, কোদালিয়া হাওর, ঝিনুয়া হাওর ও মাকালকান্দি হাওরের ফসল রক্ষার জন্যও স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছা শ্রমে বাঁধ দিচ্ছে।

(প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য পাঠিয়েছেন আহমেদ নূর, শামস শামীম, নাসরুল আনোয়ার, হাফিজুর রহমান চয়ন, মিজানুর রহমান নান্নু, শাহ ফখরুজামান)ই। তিনি জানান, তাঁর এলাকার প্রান্তিক ও মধ্যমানের চাষিদের এবার ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর